শিশুদের সুরক্ষায় দেশব্যাপীস সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে ইউনিসেফের সহায়তায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ চালু হয়েছে। দেশের যেকোনো প্রান্তের কোনো শিশু কোনো ধরনের সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষনের শিকার হলে শিশু নিজে অথবা অন্য যে কোন ব্যক্তি বিনামূল্যে ১০৯৮ হেল্পলাইনে ফোন করে সহায়তা চাইতে পারবেন । এক্ষেত্রে আপনার প্রতিকার চাইবার পথটি সহজ হয়ে যাবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় অধীন সমাজসেবা অধিদফতর শিশুআইন ২০১৩ অনুসারে শিশুঅধিকার ও শিশুর সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইউনিসেফ এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় সারাদেশব্যাপী ‘Child help line 1098’ এর কার্যক্রম গত ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সর মাধ্যমে ‘Child help line 1098’ এর দেশব্যাপী চালুর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। Toll free short code ‘1098’ এর মাধ্যমে বাল্য বিবাহ, শিশুশ্রম, শিশুনির্যাতন, শিশু পাচার ইত্যাদি শিশু অধিকার লংঘন সংক্রান্ত তথ্যাদি ‘Child help line 1098’ এর মাধ্যমে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে শিশুঅধিকার ও শিশুর সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সার্বক্ষণিক (24X7) প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ঢাকার আগারগাঁওস্থ সমাজসেবা অধিদফতরের ৮ম তলায় Child help line এর Centralized Call Center (CCC) স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটিরদিনসহ ২৪ ঘণ্টা Call Center টির কার্যক্রম চালু থাকে।
১০৯৮ হেল্পলাইন কী ?
এটি এমন একটি ব্যবস্থা বা পরিসেবা, যা সকল প্রকার প্রভাব বা চাপমুক্ত থেকে শিশুর সুরক্ষা প্রদানে সকল প্রকার গোপনীয়তা রক্ষা করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সাধারন ফোনের মাধ্যমেই মানুষ ১০৯৮ হেল্পলাইনের সাহায্য পেয়ে থাকে। ২৪ ঘন্টায়ই দেশের যেকোন অঞ্চল থেকে ১০৯৮হেল্পলাইন এ ফোন করে সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
১০৯৮ হেল্পলাইনের কেন দরকার হয় ?
অনেক সময় শিশুরা বা বড়রা তাদের সমস্যা বা সুরক্ষা প্রয়োজন- একথাটি বন্ধু বা পরিবারের লোকজনদের কাছে বলতে পারে না। যেমন- কিশোরীরা ইভটিজিং-এর শিকার হলে কাউকে বলতে ভয় পায়। সকলে ভাবে যে, তাদের সমস্যা অন্য কেউ বুঝতে পারবে না, বা নিজেদের সমস্যার কথা বললে চারপাশের সবাই তাদের সঙ্গে অন্যরকম ব্যবহার করবে। কিছু ক্ষেত্রে খুব সংবেদনশীল বিষয়ও আমরা আমাদের কাছের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই না। অনেক সময় শিশুরা মুখ ফুটে কোনও কথা বলতে পারেনা কিংবা কীভাবে নিজের কথা বলা উচিত, সে সর্ম্পকে কোনও স্পস্ট ধারনা থাকে না। এরকম পরিস্থিতিতে, হেল্পলাইনের সাহায্য নিয়ে প্রতিকার পাওয়া যাবে।
১০৯৮ হেল্পলাইন কী সহায়তা করে?
১০৯৮ হেল্পলাইন কিভাবে সহায়তা করে?
চাইল্ড হেল্পলাইন-১০৯৮ অর্জন
(ডিসেম্বর ২০১৫ থেকে নভেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত)
কেস স্টাডি ১: চার শিশুর আইনগত অধিকার নিশ্চিতকরণ
রহিমা (১২), কলি (১০), মমতাজ (৯) এবং তাসলিমা (১২) সবাই হাজারীবাগ এলাকায় বউ বাজার এলাকায় পিতা-মাতার সাথে বসবাস করছে। তাদের পিতা-মাতা খুবই দরিদ্র, কেউ রিক্সা চালায় কিংবা দিনমজুর। গত ৬ মার্চ ২০১৬ তারিখ বিকালে একজন ব্যক্তি ফোন দিয়ে জানায়, উল্লেখিত শিশুরা যৌননির্যাতনের শিকার। নির্যাতনকারী মিজান, বয়স আনুমানিক ৪২ বছর, বউ বাজার এলাকায় হোটেল ব্যবসা রয়েছে। কলার জানান, বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ভাবে সালিশীর আয়োজন করা হয় এবং ধর্ষককে চর-থাপ্পর দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিবাবকগণ উক্ত সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয় বিধায় চাইল্ড হেল্পলাইনের সহায়তা কামনা করেন। তারা আইনগত ভাবে বিষয়টির সুরাহা চান।
হেল্পলাইন বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে প্রবেশন কর্মকর্তার নিকট ও পরবর্তীতে কলার এর সাথে হাজারীবাগ থানার ওসির সাথে কলারসহ কল কন্ফারেন্স এর মাধ্যমে তথ্য দেওয়া হয়। হাজারীবাগ থানার ওসির সহায়তায় ৮ মার্চ ২০১৬ তারিখে যৌন হয়রানী মামলা হয়। প্রবেশন কর্মকর্তা ও হেল্পলাইনের ক্রমাগত যোগাযোগের মাধ্যমে পুলিশ ৮ মার্চ ২০১৬ তারিখেই রাত নয়টার সময় নির্যাতনকারী মিজানকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে একজন শিশুর পিতা জনাব আব্দুর রহিম হেল্পলাইনে ফোন করে জানান, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উক্ত মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবি নিয়োগের মতো আর্থিক সঙ্গতি তার নাই। বিষয়টির দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে কলারকে Law Support Center for Human Rights প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জনাব এডভোকেট আলাউদ্দিন খান (০১৭১২৮২৩২৫৬) এর সাথে কন্ফারেন্স এর মাধ্যমে পুরো বিষয় অবহিত করা হয় এবং উক্ত মামলা পরিচালনার জন্য সহায়তা চাওয়া হয়। এডভোকেট আলাউদ্দিন খান মামলাটি পরিচালনার জন্য সহায়তা প্রদান করবেন বলে সম্মতি দেন এবং ঐদিনই কোর্টে হাজিরা দেন।
দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া পর বিজ্ঞ আদালত নির্যাতনকারী কে সাজা প্রদান করেন। শিশুরা বর্তমানে বাবা-মা এর সাথে আছে এবং নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে।
কেস স্টাডি-২: রেললাইন থেকে শান্তির নীড়ে
কুমিল্লা রেল ষ্টেশনের কাছে সাত মাস বয়সি একটি শিশু পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশের সহায়তায় শিশুটিকে নিকটস্থ একটি পরিবারের নিকট হস্তান্তর করে। শিশুটির মুখ মন্ডলে দাগ এবং একটি পা তুলতে পারেনা (প্রতিবন্ধি)। অজ্ঞাত এ শিশুটির বিষয় কুমিল্লার সমাজ সেবা এর প্রবেশন অফিসার জনাব নূরুল আমিন কে স্থানীয় শিশুবান্ধব পুলিশ অফিসার অবহিত করলে, তিনি প্রথমে শিশুটির পরিবার খোঁজেন। পরিবার না পেয়ে তিনি শিশুটির জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা তথা আশ্রয় এর জন্য কোর্টের মাধ্যমে সমাজসেবা অধিদফতর পরিচালিত ঢাকাস্থ ছোটমণি নিবাসে প্রেরণ করেন।
ছোটমণি নিবাসে প্রতিবন্ধি শিশুর জন্য বিশেষায়িত সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা না থাকায় শিশুটিকে পুনরায় কুমিল্লা প্রবেশন অফিসার এর নিকট ফেরত পাঠানো হয়। প্রাথমিকভাবে যে পরিবারে শিশুটি আশ্রয় পেয়েছিলো প্রবেশন অফিসার সেখানে শিশুটিকে অন্তবর্তিকালীন লালন পালনের জন্য রাখেন। প্রবেশন অফিসার শিশুটির সর্বোত্তম স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সাথে পুনরায় যোগাযোগ শুরু করেন, সবাই শিশুটিকে গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে।
এ দিকে শিশুটি সাময়িক ভাবে যে পরিবারে ছিলো তারা ছিলো খুবই দরিদ্র, শিশুটিকে তারা ভিক্ষার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। শিশুটির সুরক্ষায় রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবেশন অফিসার অবশেষে সমাজসেবা অধিদফতর এর মহাপরিচালক (ডিজি) জনাব গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবির (অতিরিক্ত সচিব) মহোদয় এর সরণাপন্ন হউন। ডিজি মহোদয়ের তাৎক্ষণিক নির্দেশ মোতাবেক প্রবেশন অফিসার গত ২৬ ডিসেম্বর সমাজসেবার, চাইল্ড হেল্পলাইন-১০৯৮ এ ফোন করে শিশুটির নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সহযোগীতা চান।
হেল্পলাইন শিশুটির যাবতীয় তথ্য গ্রহণ করার পর, Resource Directory থেকে বিভিন্ন সেবাদান প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে। অবশেষে ২৯ ডিসেম্বর 2016 তারিখ পরিত্যক্ত শিশু নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান মাদার তেরেসা’র উপপরিচালক শিশুটিকে গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সংস্থাটির আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৬ জানুয়ারী ২০১৭ আদালতের আইনী প্রক্রিয়া শেষে বিজ্ঞ আদালত শিশুটিকে মাদার তেরেসা (বেসরকারী সংস্থার) নিকট প্রেরণ করার জন্য অনুমতি প্রদান করেন।
১৭ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে শিশুটিকে সরাসরি কুমিল্লা থেকে ঢাকায় উক্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসা হয়। শহর সমাজসেবা কার্যালয়-৩, ঢাকার তত্বাবধানে আনুষ্ঠানিকভাবে শিশুকে মিশনারীজ অফ চ্যারিটি মাদার তেরেসা, ২৬ ইসলামপুর রোড, ঢাকায় হস্তান্তর করা হয়। শিশুটির নাম রাখা হয় খাদিজা। বর্তমানে শিশুকে মিশনারীজ অফ চ্যারিটি মাদার তেরেসায় সুন্দরভাবে বেড়ে উঠছে।
কেস স্টাডি-৩: বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ
শিশু নাসিমা আক্তার (১৫), বাবা আরমান হোসেন, মা মরিয়ম বেগম, ঢাকা সিটি করপরেশন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ারী থানাধীন ২৮/২, কেএম দাশ লেন ঢাকা-১২০৩ এর হরদহ গ্লাস ফ্যাক্টরীর ৪ নং কোয়ার্টারে বসবাস করেন। সে টিকাটুলী শহীদ নবী উচ্চ বিদ্যালয় এ বানিজ্য শাখায় নিউ টেনে পড়ে। তার ক্লাস রোল-৪, শিশুটির ১ম সাময়িক পরীক্ষা চলছে এমতাবস্থায় তাকে তার মা বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
২৩ মার্চ ২০১৭ তারিখ দুপুর ১২:৪৬টা ওয়ার্ড ভিশনের কর্মী মেঘলা বাংলাদেশ চাইল্ড হেল্প লাইন-১০৯৮ এ ফোন করে জানান তার ছোট বোনের বান্ধবী নাসিমা আক্তারের আজকে সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ, কাল বিয়ে। তার মা ভাল ছেলে পেয়েছে তাই শিশুর বাবার অনুমতি ছাড়া মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। কলার বাল্য বিয়েটি বন্ধের জন্য ১০৯৮ এর সহযোগীতা চান।
তাৎক্ষণিক ভাবে শিশুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক এর সাথে শিশুর বিয়ের বিষয়ে কথা বলা হয়। সহকারী শিক্ষক তথ্য দেন যে শিশুটিকে তার ফুফুর বাসা সৃত্রাপুরের লক্ষী বাজারে নিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন।
পরবর্তীতে ঢাকা জেলার শহর সমাজসেবা অফিস-১, এর সমাজসেবা অফিসার জনাব নুরুল ইসলাম ও ওয়ারী থানার ওসি কে শিশুর বিয়ে বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তথ্য দেওয়া হয়।
সমাজসেবা অফিসার নুরুল ইসলাম ও থানার সহযোগীতায় শিশু প্রিয়ার যেখানে বিয়ের আয়োজন করেছেন সেই এলাকার স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে শিশুর বাবাকে বিয়ের ক্ষতিকারক দিক তথা আইনি বিষয়গুলি অবহিত করেন। শিশুর বাবা মা পরিশেষে বুঝতে পেরে এ মর্মে লিখিত দেন যে, শিশুর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হলে , তার পূর্বে কোন প্রকার বিয়ের ভাবনা নয়। শিশুটির পড়ালেখার ক্ষেত্রে কোন সহায়তার প্রয়োজন হলে অভিবাবককে সহায়তা প্রদান করা হবে বলে সমাজসেবা অফিসার পরিবারকে আশ্বস্ত করেন। এভাবেই বন্ধ হয় নাসিমা আক্তার এর বিয়ে। বর্তমানে সে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে।
বিশেষ প্রয়োজনে যোগাযোগ
চাইল্ড সেনসিটিভ সোস্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্প
সমাজসেবা অধিদফতর (অষ্টম তলা)
ই-৮/বি-১, আগারগাঁও, ঢাকা
ফোন: ৫৮১৫৩৫৩৫, ৫৮১৫২৮৪২
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS